নবীজীকে ভালোবাসার কয়েকটি কারণ
নবীজিকে সর্বাপেক্ষা বেশি ভালোবাসতে হবে কেন?
ব্রাদারানে ইসলাম! সহীহ বুখারীর বিখ্যাত আরবী ব্যাখ্যাগ্রন্থ উমদাতুল কারী এবং উর্দু ব্যাখ্যাগ্রন্থ নসরুল বারীতে সহীহ বুখারীর ১৪ নম্বর হাদীসের ব্যাখ্যায় লেখা আছে,
পৃথিবীর সকল দার্শনিকগণ এ বিষয়ে একমত যে, কাউকে ভালোবাসার ৪টি কারণ হতে পারেঃ
- তার সৌন্দর্যতার কারণে,
- তার ভাল গুণের কারণে,
- আত্মীয়তার কারণে,
- কাউকে ভালোবাসা হয় তার অনুগ্রহের কারণে।
বিশ্বনবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মধ্যে ভালোবাসার এই ৪টি কারণ পূর্ণাঙ্গরূপে বিদ্যমান ছিল।
নবীজীকে ভালোবাসার প্রথম কারণ
নবীজির সৌন্দর্য
নবীজির সৌন্দর্য বর্ণনা করা অসম্ভব।
তবে এতটুকু তো অবশ্যই বলা যায় যে, তিনি কুল-কায়েনাতের এবং সকল সৃষ্টির মধ্যে সর্বাধিক সুন্দর ছিলেন।
কোন সৃষ্টির সাথে তাঁর সৌন্দর্যের তুলনাই হয় না।
সুনানে দারাকুতনীর ২৫৭০ নম্বর হাদীসে হযরত আনাস (রযি) থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেছেনঃ
আল্লাহ রব্বুল আলামীন পৃথিবীতে যত নবী পাঠিয়েছেন, সকলের আকৃতি ও কণ্ঠস্বর ছিল সুন্দর।
আর তোমাদের নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের সকলের চেয়ে বেশি সুন্দর ছিলেন।
মনে রাখবেন, নবীজির যুগে ৩ জন সাহাবী কবি ছিলেন।
- হাসান বিন সাবিত (রযি)
- আব্দুল্লাহ বিন রাওয়াহা (রযি)
- কা’ব বিন মালিক (রযি)
এদের মধ্যে প্রধান কবি ছিলেন হযরত হাসান বিন সাবিত (রযি)।
তিনি ইসলাম গ্রহণের পর নবীজির সৌন্দর্যের প্রশংসায় একটি বিখ্যাত কবিতা রচনা করেছিলেন।
কবিতাটি ‘দেওয়ানে হাসান’ নামক কিতাবের ১৭ নম্বর পৃষ্ঠায় এভাবে লেখা আছে,
وَأَحْسَنُ مِنكَ لَمْ تَرَ قَطُّ عَيْنِي
وَأَجْمَلُ مِنكَ لَمْ تَلِدِ النِّسَاءُ
خُلِقتَ مُبَرَّءٌ مِن كُلِّ عَيْبٍ
كَأَنَّكَ قَد خُلِقتَ كَمَا تَشَاءُ
অর্থ: আপনার মতো অপূর্ব সুন্দর আমার চোখ কখনও দেখেনি।
আর পৃথিবীতে কোন মহিলার গর্ভে আপনার চেয়ে সুন্দর মানুষ জন্মগ্রহণ করিনি।
আপনি যাবতীয় দোষত্রুটি মুক্ত পয়দা হয়েছেন।
যেন আপনি যেমন চেয়েছেন, তেমন পয়দা হয়েছেন।
আমরা অনেকে কুরআন করীমে সূরা ইউসুফের মধ্যে নবী ইউসুফ আলাইহিস সালামের ঘটনা শুনেছি।
তাঁর আকৃতি ও গঠন এত সুন্দর ছিল যে, মিশরের নারীরা তাঁর চেহারার সৌন্দর্যের দিকে তাকিয়ে আত্মহারা হয়ে ছুরি দিয়ে হাতের ফল না কেটে আঙুল কেটে ফেলেছিল।
এ ঘটনা সূরা ইউসুফের ৩১ নম্বর আয়াতে বর্ণিত আছে।
কিন্তু আমাদের নবীজী মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর চেয়েও অনেক বেশি সুন্দর ছিলেন।
‘খসাইলে নববী’ নামক কিতাবের ১৬ নম্বর পৃষ্ঠায় লেখা আছে, উম্মুল মু’মিনীন আইশা সিদ্দীকা (রযি) বলেছেনঃ
মিশরের নারীরা ইউসুফ আলাইহিস সালামের সৌন্দর্য দেখে হাতের আঙুল কেটে ফেলেছিল।
কিন্তু তারা যদি আমার নবীর সৌন্দর্য দেখত, তাহলে নিজেদের দিল-কলিজা কেটে ফেলত।
নবীজীকে ভালোবাসার কয়েকটি কারণ-Nobiji ke Valobashar ko ekti karon
নবীজীকে ভালোবাসার দ্বিতীয় কারণ
নবীজির আচার-ব্যবহার
সম্মানিত উপস্থিতি! কারোর প্রতি মহব্বত পয়দা হওয়ার দ্বিতীয় কারণ হল, তার ভাল আচার-ব্যবহার।
এ কারণটিও নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মধ্যে ১০০ শতাংশ মজুদ ছিল।
بعثتُ لِأَتَمَ مَكَارِمَ الْأَخْلَاقِ
অর্থ: আমি উত্তম আদর্শ সমূহকে পরিপূর্ণ করার জন্য প্রেরিত হয়েছি।
এজন্যই নবীজির জীবনচরিত সাক্ষী, তাঁর আখলাক-চরিত্র ও আচার-ব্যবহার ছিল অপূর্ব ও অতুলনীয়।
সহীহ বুখারীর ৬১০২ নম্বর হাদীসে আবু সাঈদ খুদরী (রযি) থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেছেনঃ
নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পর্দানশীন কুমারী মেয়ের চেয়ে অধিক লজ্জাশীল ছিলেন।
সুনানে তিরমিযীর ২০১৬ নম্বর হাদীসে আম্মাজান আইশা সিদ্দীকা (রযি) নবীজির উন্নত আদর্শ বর্ণনা করে বলেছেনঃ
لَمْ يَكُنْ فَاحِشًا وَلَا مُتَفَحِّشًا وَلَا صَخَابًا فِي الْأَسْوَاقِ وَلَا يَجْزِي بِالسَّيِّئَةِ السَّيِّئَةَ وَلَكِنْ يَعْفُوْ وَيَصْفَحُ
অর্থ: “রসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কটুকথা বলতেন না;
এমনকি তিনি অশ্লীল কথা মুখে উচ্চারণও করতেন না।
তিনি বাজারে চেঁচামেচি করতে না।
কারোর দূর্ব্যবহারের বদলায় দূর্ব্যবহার করতেন না;
বরং তিনি উদারচিত্তে ক্ষমা করে দিতেন।”
আমরা জানি, কোন মানুষের চরিত্র সম্পর্কে জানতে হলে তার পরিবার-পরিজন ও সাথী-সঙ্গীদের কাছ থেকেই তা জানতে হয়।
আর একজন মানুষের দূর্বলতা সবচেয়ে বেশি জানে তার স্ত্রী।
এতদসত্ত্বেও আম্মাজান আইশার বর্ণনা তো আমরা এখুনিই শুনলাম। যিনি নবীজির সঙ্গে দীর্ঘ ১২ বছর বৈবাহিক জীবন কাটিয়েছিলেন।
এবার আমরা নবীজির বিশিষ্ট খাদিম হযরত আনাস রযিয়াল্লাহু আনহুর একটি বর্ণনা লক্ষ্য করি।
আনাস (রযি) দীর্ঘ ১০ বছর যাবত নবীজির খিদমত করেছেন।
মুসনাদে আহমাদের ১৩০৩৪ নম্বর হাদীসে বর্ণিত আছে, সেই খাদিমে রসূল আনাস (রযি) বলেছেনঃ
“আমি রসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দীর্ঘ ১০ বছর খিদমত করেছি।
আল্লাহর কসম, তিনি আমাকে কখনও গালি দেননি।
এমনকি কখনও আহ্ পর্যন্ত বলেননি।
আর কখনও কোন কাজের জন্য ধমক দিয়ে বলেননি যে, এটা কেন করনি? কিংবা ওটা কেন করেছ?…
নবীজীকে ভালোবাসার কয়েকটি কারণ-Nobiji ke Valobashar ko ekti karon
নবীজীকে ভালোবাসার তৃতীয় কারণ
নবীজির সাথে উম্মতের নৈকট্যঃ
মুহতারম শ্রোতামণ্ডলী! কারোর প্রতি ভালোবাসার তৃতীয় কারণ হল, তার নিকটতম হওয়া।
নবীজি হলেন সৃষ্টিজগতে আমাদের সর্বাপেক্ষা নিকটতম।
এমনকি তিনি আমাদের জন্য স্বয়ং আমাদের জানের চেয়েও নিকটতম।
সূরা আহযাবের ৬ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা এ কথাই বলেছেন:
النَّبِيُّ أَوْلَى بِالْمُؤْمِنِينَ مِنْ أَنْفُسِهِمْ
“নবী মু’মিনদের নিকট তাদের নিজেদের চেয়েও অধিক ঘনিষ্ঠ।”
অতএব, নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মোমিনদের জন্য যখন সবচেয়ে বেশি ঘনিষ্ঠ, তখন তাঁকে সৃষ্টিজগতে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসা মু’মিনদের ঈমানের দাবি।
নবীজীকে ভালোবাসার কয়েকটি কারণ-Nobiji ke Valobashar ko ekti karon
নবীজীকে ভালোবাসার চতুর্থ কারণ
নবীজির অনুগ্রহ ও অনুদানঃ
সুধী শ্রোতামণ্ডলী! কারোর প্রতি মহব্বত পয়দা হওয়ার চতুর্থ কারণ হল, ইহসান ও অনুগ্রহ।
রসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মধ্যে এ কারণটিও পরিপূর্ণ রূপে মজুদ ছিল।
প্রত্যেকটি মু’মিনের উপর, বরং প্রত্যেকটি সৃষ্টির উপর নবীজির অনুগ্রহ অপরিসীম।
তাঁর মাধ্যমে আমরা ঈমান পেয়েছি। তিনি আমাদেরকে জান্নাতের পথ দেখিয়েছেন। গ্রন্থমুকুট আল কুরআন তিনিই আমাদের হাতে তুলে দিয়েছেন।
তিনি না হলে আমরা হতাম মুশরিক ও জাহান্নামী।
তিনি না হলে আজ এ ধুলির ধরায় আল্লাহর নাম উচ্চারণকারী কেউ হত না।
আর দুনিয়া ততদিন থাকবে, যতদিন আল্লাহর নাম থাকবে।
তাই বলা যায়, এ চাঁদ, সূর্য, নক্ষত্ররাজি, নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডল সবকিছুর উপর তাঁর অবদান অপরিসীম। এ জন্যই আল্লাহ রব্বুল আলামীন সূরা আম্বিয়ার ১০৭ নম্বর আয়াতে বলেছেন:
وَمَا أَرْسَلْنَاكَ إِلَّا رَحْمَةً لِلْعَالَمِينَ
অর্থ: “আমি আপনাকে সৃষ্টিজগতের জন্য রহমত হিসাবেই পাঠিয়েছি।”
আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে নবী রহমাতুললিল আলামীনকে প্রাণের চেয়ে অধিক ভালোবেসে তাঁর সুন্নাহর আলোকে জীবন গড়ার তাওফীক দান করুন। আমীন, ইয়া রব্বাল আলামীন।
আসসালামু আলাইকুম।
প্রিয় পাঠক!
আমার নাম মোঃ নাজামুল হক, আমি একটি ইসলামী মাদ্রাসার শিক্ষক।
আমি মাদ্রাসা শিক্ষার পাশাপাশি অনলাইনে ইসলামিক প্রবন্ধ লিখতে থাকি, যাতে মানুষ সঠিক বিষয় জানতে পারে।
আপনি আমাদের সাথে সংযুক্ত থাকুন এবং সঠিক তথ্য থেকে উপকৃত হন।
আপনার যদি কোন প্রশ্ন থাকে বা আমাদের কোন ভুল সম্পর্কে জানাতে চান, তবে আমাদের সাথে যোগাযোগ করতে পারেন, জাযাকুমুল্লাহু খাইরন।