মুহাররম মাসের রোযার ফযীলত
Muharram Maser Rozar Fozilot
প্রিয় পাঠক, আজকে আমরা মুহাররম মাসের আমল সম্পর্কে আলোচনা করব।
মুসলিম শরীফের ১১৩২ ও বুখরী শরীফের ১৯০২ নম্বর হাদীসে বর্ণিত আছে,
হযরত ইবনে আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহু) কে আশুরা (মুহাররম মাসের দশ তারিখের) রোযা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে,
উত্তরে তিনি বলেছিলেনঃ রসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রমাযান মাস এবং আশুরার দিনের রোযার চেয়ে বেশি ফযীলতের আশায় কোন রোযা রেখেছেন বলে আমার জানা নেই।
এ হাদীস দ্বারা আমরা বুঝতে পারলাম যে, রমাযান মাস এবং আশুরার দিনের রোযার ফযীলত সবচেয়ে বেশি।
মুহাররম মাসে (দশম মুহাররম ছাড়া) যে কোনো দিনেও রোযা রাখার ফযীলত অন্য মাসের চেয়ে বেশি।
সহীহ মুসলিমের ১১৬৩ নম্বর হাদীসে সাহাবী আবুহুরাইরাহ রযি হতে বর্ণিত আছে,
রসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ
أَفْضَلُ الصِّيَامِ بَعْدَ رَمَضَانَ شَهْرُ اللَّهِ الْمُحَرَّمُ
“রমাযান মাসের পর সবচেয়ে উত্তম রোযা আল্লাহর মুহররম মাসের রোযা ।”
মনে রাখবেন, সব মাসই আল্লাহর মাস।
কিন্তু এ হাদীসে বিশেষ করে মুহররম মাসকে আল্লাহর মাস বলে ঘোষণা করাই এ মাসের মহা ফযীলতের দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে।
মুহাররাম মাসের আশুরার রোযার ফযীলত
Muharram Maser Ashurar Rozar Fozilot
এক ব্যক্তি হযরত আলী ((রযিয়াল্লাহু আনহু)) কে জিজ্ঞেস করেছিল, রমাযান মাসের পর আমি কোন মাসে রোযা রাখব?
তখন হযরত আলী (রযিয়াল্লাহু আনহু) বলেছিলেনঃ
এ সম্পর্কে কেবল একজন লোককে আমি প্রশ্ন করতে শুনেছি।
হযরত আলী (রযিয়াল্লাহু আনহু) নবীজির কাছে বসেছিলেন, তখন এক ব্যক্তি নবীজিকে জিজ্ঞেস করেছিলেন,
ইয়া রসূলাল্লাহ! রমাযান মাসের পর আপনি আমাকে কোন মাসে বোয়া রাখতে আদেশ দেবেন?
তখন নবীজি বলেছিলেনঃ যদি তুমি রমাযান মাস ছাড়া আরও রোযা রাখতে চাও, তবে তুমি মুহাররম মাসে রোযা রাখ।
কেননা এটা আল্লাহর মাস। এ মাসে এমন একটা দিন আছে, যেদিন আল্লাহ তায়ালা এক সম্প্রদায়ের তাওবা কবুল করেছিলেন এবং তিনি আরও একটি জাতির তাওবা কবুল করেছিলেন।
এ হাদীস দ্বারা বোঝা যায় যে আশুরার দিন ছাড়াও মুহাররম মাসের অন্যান্য দিনে রোযা রাখা অন্য মাসের সাধারণ দিনে রোযা রাখার চেয়ে বেশি সাওয়াব লাভের উপায়।
ইবাদত উপাসনার ক্ষেত্রেও বিধর্মীদের সামঞ্জস্য ঠিক নয়ঃ
সুধীবৃন্দ! রসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদীনায় আসার পর ইয়াহুদীদেরকে আশুরার দিন রোযা রাখতে দেখে তিনি তাদেরকে জিজ্ঞেস করেছিলেন,
তোমরা এ দিনে কেন রোযা রাখ?
উত্তরে তারা বলেছিলঃ এটা মহত দিন।
আল্লাহ তায়ালা এ দিনে হযরত মুসা (আলাইহিস সালাম) ও তাঁর জাতিকে ফিরআউনের যুলুম-অত্যাচার থেকে মুক্তি দিয়েছিলেন এবং ফিরআউন ও তার জাতিকে ডুবিয়ে দিয়েছিলেন।
তাই হযরত মূসা আলাইহিস সালাম আল্লাহর শুকরিয়া নিবেদনের জন্য রোযা রেখেছিলেন।
তাই আমরাও রোযা রাখি।
তখন নবীজি বলেছিলেনঃ তোমাদের চেয়ে আমরা মূসা আলাইহিস সালামের বেশি হক রাখি।
সুতরাং তিনি এ দিন রোযা রাখেন এবং সাহাবেদেরকে রোযা রাখার আদেশ দেন।
সহীহ মুসলিমের ১১৩০ নম্বরে এ হাদীসটি হযরত ইবনে আব্বাস (রযিয়াল্লাহু আনহু) বর্ণনা করেছেন।
যেহেতু এ দিনে ইয়াহুদিরাও রোযা রাখে, তাই যাতে তাদের সাথে সামঞ্জস্যতা বা মিল না হয়, তাই তিনি বলেছিলেনঃ
আল্লাহ তায়ালা যদি চান তবে আমি আগামী বছর ৯য় তারিখেও রোযা রাখব।
কিন্তু পরের বছর আসার আগেই নবীজি ইন্তেকাল করেন।
তাই আশুরার আগের দিন অর্থাৎ মুহাররমের ৯ তারিখে রোযা রাখাও মুস্তাহাব।
যদি কোন কারণে মুহাররম মাসের ৯ তারিখে রোযা না রাখা হয়, তবে ১১ তারিখে রোযা রাখা দরকার।
যাতে ইয়াহুদীদের সাথে সামঞ্জস্য (মিল) না হয়ে যায়।
মুহাররম মাসের রোযার ফযীলত-Muharram Maser Rozar Fozilot
প্রিয় শ্রোতামন্ডলী! এ সব হাদীস দ্বারা আমরা মুহররম মাসের ফযীলত জানতে পারলাম।
এ মাসে আল্লাহ তায়ালা বান্দাদের প্রতি খুবই রহমত বর্ষণ করেন তাদের গোনাহ মাফ করে দেন।
তাই আমাদের দরকার, যে আমরা এ মাসে বেশি করে ইবাদত করব এবং পরজগতের (আখিরাতের) কথা স্মরণ করে বেশি বেশি তওবা ইস্তেগফার করব,
কারণ, পরকালের স্মরণ মানুষকে দুনিয়ার ধোঁকা থেকে উদ্ধার করে ইবাদতের প্রতি আগ্রহী করে।
এ সম্পর্কে আমরা একটি উপদেশ মূলক একটি ঘটনা জেনে রাখি।
বাদশাহ ইমরুউল কাইস কিন্দী একজন বিলাসী লোক ছিলেন।
দিন রাত তিনি আনন্দ-ফুর্তিতে মেতে থাকতেন।
একবার তিনি ভ্রমনের উদ্দেশ্যে জঙ্গলে যান এবং সেখানে তার বন্ধু-বান্ধবদের সাথে আমোদ-প্রমোদে মেতে উঠেন।
হঠাৎ তিনি দূরে একটি লোক দেখতে পান,
লোকটি তার সামনে অনেকগুলি মৃত দেহের হাড় জমা করে রেখেছে।
আর তা নিয়ে নাড়া চাড়া করছে।
বাদশা ইমরুউল কাইস লোকটির কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করেন,
ভাই তোমার এ করুণ অবস্থা কেন? মনে হয় তুমি কোন কিছুর ভয়ে ভীষণ ভীত হয়ে আছ!
লোকটি বলল, আমি দীর্ঘ পথের মুসাফির। আমার পিছনে দু’জন প্রহরী সবসময় নিযুক্ত আছে।
তারা আমাকে অন্ধকার ও সংকীর্ণ কবরের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
সেখানে আমার শরীরের গোশত পঁচে গলে নষ্ট হয়ে যাবে। হাড়-হাড্ডি চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে যাবে। বিভিন্ন রকম আযাব হবে। এই শরীর পোকার খোরাক হবে।
আর সেখানেই যদি সব শেষ হয়ে যেত তবে দুঃখের কিছু ছিল না। কিন্তু বাস্তব কথা হল, সেখানেই কষ্টের শেষ নয়।
বরং কিয়ামতের দিন আমাকে কবর থেকে উঠান হবে। তারপর আমার কৃতকর্মের হিসাব নেওয়া হবে।
হিসাবের পর আমাকে জান্নাতে যাবার অনিমতি দেওয়া হবে, নাকি জাহান্নামে পাঠিয়ে দেওয়া হবে, তা আমার জানা নেই।
তাহলে যার সামনে এমন ভয়াবহ অবস্থা অপেক্ষা করছে, সে কিভাবে নিশ্চিন্ত মনে দুনিয়ার আয়েস-আরামে মশগুল থাকতে পারে?
বাদশা ইমরুউল কাইস ঘোড়ার পিঠে বসে এসব কথা শুনছিলেন। লোকটির কথায় তার মনের মাঝে পরিবর্তনের ঝড় উঠে।
লোকটির কথায় তার মনের মাঝে পরিবর্তনের ঝড় উঠে। তিনি নত মস্তকে ঘোড়ার পিঠ থেকে নীচে নেমে আসেন এবং লোকটির সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পড়েন এবং বলেনঃ
তোমার কথা আমার জীবনকে পরিবর্তন করে দিয়েছে।
তুমি যে কথাগুলো বলেছিলে, তা পুনরায় আমাকে শুনাও। যাতে আমার অন্তরচোখ খুলে যায়।
ইমরুউল কাইসের অনুরোধে লোকটি নিজের কথাগুলো পুনরায় বয়ান করে।
লোকটি ইমরুউল কাইসকে বলে, আমার সামনে যে হাড়-হড্ডি রাখা আছে, আপনি তা লক্ষ্য করেছেন?
বাদশা বলল হ্যাঁ তখন লোকটি বলে, এগুলো সব প্রতাপশালী রাজা-বাদশাদের মৃত দেহের হাড়-হাড্ডি।
দুনিয়া তাদেরকে ধোঁকায় ফেলে সারা জীবন আয়েস-আরামে মশগুল রেখেছিল।
এভাবে বেখবর অবস্থায় তারা মৃত্যু মুখে পতিত হয়েছে।
মৃত্যুর মাধ্যমে তাদের দুনিয়ার সুখ-শান্তির সমাপ্তি হয়েছে।
ধন-সম্পদ তাদের কাছ থেকে চিরদিনের জন্য হাতছাড়া হয়েছে।
অতিসত্বরে এই হাড়গুলো আবার আপন আপন দেহে যুক্ত হয়ে যাবে এবং কিয়ামতের মাঠে নিজ নিজ কৃতকর্মের প্রতিফল স্বরূপ হয়তো তারা জান্নাতে যাবে অথবা জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে।
এ কথা বলেই লোকটি হঠাৎ দৃষ্টি থেকে উধাও হয়ে যায়।
চতুর্দিকে সন্ধান করেও তাকে খুঁজে পাওয়া যায় নি।
এদিকে বাদশার সাথীরা এক এক করে বাদশার পাশে এসে দাঁড়ায়।
তারা বাদশাকে দেখে অবাক হয়ে যায়। বাদশার গায়ের রং ফ্যাকাশে হয়ে গেছে এবং তার দু’চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরছে।
দীর্ঘ সময় এমন ভাবে থাকার পর তিনি এ সিদ্ধান্ত নেন যে, ক্ষণস্থায়ী দুনিয়ার পিছনে আর নয়। বাকী জীবনটুকু আল্লাহর রাস্তায় উৎসর্গ করব।
অতঃপর গভীর রাতে তিনি শাহী পোশাক খুলে সাধারণ পোশাক পরে রাজমহল ছেড়ে বেরিয়ে যান। তাকে আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় নি।
ইবনে কুদামাহ (রহমাতুল্লাহি আলাইহি) এ ঘটনাটি কিতাবুত্তাওয়াবীনের ৩৫ পৃষ্ঠায় লিখেছেন।
আল্লাহ তায়ালা আমাদের সকলকে পরকালের কথা স্মরণ করে তাঁর ইবাদত-উপাসনার তাওফীক দান করুন।
আমীন, ইয়া রব্বাল আলামীন।
আসসালামু আলাইকুম।
প্রিয় পাঠক!
আমার নাম মোঃ নাজামুল হক, আমি একটি ইসলামী মাদ্রাসার শিক্ষক।
আমি মাদ্রাসা শিক্ষার পাশাপাশি অনলাইনে ইসলামিক প্রবন্ধ লিখতে থাকি, যাতে মানুষ সঠিক বিষয় জানতে পারে।
আপনি আমাদের সাথে সংযুক্ত থাকুন এবং সঠিক তথ্য থেকে উপকৃত হন।
আপনার যদি কোন প্রশ্ন থাকে বা আমাদের কোন ভুল সম্পর্কে জানাতে চান, তবে আমাদের সাথে যোগাযোগ করতে পারেন, জাযাকুমুল্লাহু খাইরন।